আটতলা ভবনের ছাঁদে জমকালো দামী রেস্টুরেন্ট। খাবারের দামও কম নয় একেবারে। গরিব অসহায়দের জন্যে সেখানে যাওয়ার পথ যেন আকাশসম দূরত্বে। কিন্তু সেই দূরত্ব ঘুচে যায় শুক্রবার এলেই। খাবার, খাবারের দামী জায়গা, ৮ তলা ভবনের জমকালো ছাঁদ সব নেমে আসে গরীব, দুঃখী অসহায় মানুষদের জন্য। একদিন পুরো রেস্টুরেন্ট দখলে থাকে তাদেরই। পেটপুরে দামী খাবার খান সামর্থ্যহীনরা।
সাভার বাজারের চৌরঙ্গী মার্কেটে সিপন হাওলাদারের মালিকানাধীন কস্তুরি রুফটপ রেস্টুরেন্টে প্রতিসপ্তাহে জুমার নামাজের পর করা হয় এ আয়োজন। এদিন সেখানে খাওয়ানো হয় প্রায় দুই’শ স্থানীয় গরিব অসহায়কে।
সম্প্রতি এক শুক্রবারে রেস্টুরেন্টটিতে গিয়ে দেখা যায়, সাজানো গোছানো বিত্তশীলদের খেতে খেতে সময় কাটানোর রেস্টুরেন্টে বসে খাবার খাচ্ছেন গরিব অসহায়রা। কথা হল খেতে আসা আজমল শেখের সঙ্গে। সাভার বাজার এলাকায় ভিক্ষা করেন তিনি। বললেন, শুক্কুরবার আইলেই এনে খাইব্যার আহি। এরহম জাগায় তো সাইজ্যের লিগাও আহা যায় না। কিন্তু উনির্যা একদিন আমাগো ডাইকা আইনাই খাওয়ায়।
নামা বাজার এলাকায় ঘুরে ঘুরে পলিথিন কুড়ান মায়মুনা আক্তার। তিনি বলেন, জ্যার কুটি ট্যাহা আছে, হ্যাঁয়ও এইরহম খাওয়ায় না। এইতে যে ডাইকা খাওয়ায়, কয়। এইতেই ম্যালা শুকরিয়া। হ্যারে আমরা দোয়া করি। হ্যারে আল্লাহ আরও দেউক। আমরা বহুত জাগায় যাই। প্রেত্যেক শুক্কুরবার হ্যায় এইরহম ডাইক্কা ডাইক্কা খাওয়ায়। অনেকেই হঠাৎ একবার খাওয়ায়। কিন্তু সাভারে এইরহম প্রেত্যেক শুক্কুরবার এইতেই খাওয়ায়।
জরিনা বেগম নামে আরেক নারী বলেন, আইজ ফজরের পর থিকা না খাওয়া। খিদায় মরতাছিলাম। দুপুরে এনে খাইতে আইছি। তিনি বলেন, আমরা এইনে খাইতে আসি, যেন তার নিজস্ব লোক। ঘরের মানুষ। মা বইন, খালা, এমনভাবে খাওয়ায়। নিজের লোক দিয়া বাইরা খাওয়ায়। আমি তার জন্যে দোয়া করি। সবসময় তার পরিবারের দোয়া করি।
জানতে চাইলে রুফটপ রেস্টুরেন্টের মালিক সিপন হাওলাদার বলেন, আমি খাবারের ব্যবসা করি। বহু মানুষ দামী খাবার খায়। কিন্তু এখান থেকে রাস্তায় বের হলেই দেখি কত মানুষ না খেয়ে আছে। আমার চিন্তা ছিল আমি ওদের জন্যে কিছু করব। পরে এদের জন্যে একদিন রাখি। রাস্তায় অনেক মানুষ না খেয়ে থাকে। আমরা কি করি। আমরা খাই, খাবার নষ্ট করি, ফেলে দেই। কিন্তু আমরা একটা খাবার বানাতে পারি না আল্লাহ ছাড়া। তখন ভাবি এটাও কারো না কারো রিজিক। এটা দিয়ে কারো ক্ষুধা মিটত। তখনই ভাবছি, বেচাকেনা করি লাভ করি। এতে অনেকেরই হক আছে। সবারই খিদার অনুভুতি আছে। আমারটা আমি মেটাতে পারি। সে পারে না। আমার ইচ্ছা হল, সবদিন না পারি, একটা দিন ওদের সঙ্গে খাই। যতদিন রেস্টুরেন্ট আছে, আমি আছি, এই নিয়ম ভঙ্গ হবে না। তারা এখানে আসবে, তারা খাবে আমি খুশি হই। আমার ভালো লাগে। আমি নামাজ পরেই আসি। খোঁজ নেই। খাওয়াই। এই একদিন একসঙ্গে দুইবেলার খাবার বানিয়ে ফেলি। যেহেতু জানি না, কতজন আসবে। ফলে নিজে থেকেই আগে বেশি করে রাঁধি। পরে খাওয়াই।
তিনি বলেন, সবাই যারযার মত করে ভাবে। আমি বা অনেকেই একইরকম দেখি। ওদের আমিও ভিক্ষুক হিসেবে দেখি অনেকের মত। কিন্তু ওদের প্রতি যে দায়িত্ব আছে, সেটা অনেকেই অনুভব করে না। আমি ব্যবসা করি, আবার এটাও ভাবি। এখন ধরেন সবাই যদি এমন ভাবত! তাইলে হয়ত সপ্তাহে ৭ দিনই সবার তিনবেলার খাবার এরেঞ্জ হয়ে যেত। না খেয়ে থাকত। আর রিজিকের মালিক আল্লাহ। আমি দেড় বছর খাইয়েছি। শুক্রবার ধরে হিসাব করলে আমি প্রায় দুই হাজারের ওপর মানুষ খাইয়েছি। কিন্তু একটু একটু করে খাওয়ানোয় অর্থনৈতিকভাবে আমি তা টেরই পাইনি। আমার একটু সংকট হলেও ওদের খাবারের আগে আমার পকেটে টাকা চলে আসে। ওরা খেয়ে যে হাসি দেয় আমি খুশি হই, এটা টাকায় পরিমাপযোগ্য না। এরা আমাকে রাস্তায় দেখলে আমাকে ডাকে। দোয়া করে। এটা টাকা দিয়ে সম্ভব না।
সিপন হাওলাদার বলেন, আমি এটা স্বার্থের জন্যেই করি। সেটা নিজের ভালো থাকার, শান্তিতে থাকার স্বার্থে। বাকিজীবন আমি এই শান্তি পেতে চাই। এছাড়া সামনে রাতের খাবার নিয়ে বের হব সামনে। ছিন্নমূলদের খাবারের জন্যে চেষ্টা করব। এসময় অন্যান্যদেরকেও এসব কাজে এগিয়ে আসতে আহ্বান জানান তিনি।